দেশে ‘আত্মহত্যা’ এখন এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট বলেছিলেন, “আত্মহত্যা জীবনে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়।” আত্মহত্যা বা আত্মহনন, ইংরেজি শব্দ Suicide হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ।
ল্যাটিন ভাষায় সুইসেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যিনি নিজেই নিজের জীবন প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি আত্মঘাতক, আত্মঘাতী বা আত্মঘাতিকা, আত্মঘাতিনীরূপে সমাজে পরিচিত হন।
অথচ আত্মহত্যা সব কিছুর সমাধান নয়। আত্মহত্যা শুধু দেহটার মৃত্যু ঘটায় তবে আসল মৃত্যুটা আত্মহত্যার পেছনে যে কারণ সে কারণেই হয়ে থাকে। প্রায় সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে আত্মহত্যা কোনো অপরাধ না হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। সম্প্রতিকালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা আমাদের সমাজে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যা মোটেও কাম্য নয়। এইসব নেতিবাচক চিন্তাভাবনা আমাদের জীবনকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে, ঠেলে দেয় আত্মহত্যার মতো ভুল সিদ্ধান্তে। মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ার ক্ষোভে আত্মহত্যা জামালপুর সরিষাবাড়ীর কিশোর হানিফের। তা-ও ফেসবুক লাইভে এসে। এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটির এ গা শিউরে ওঠা কাণ্ডের পাশাপাশি আত্মহত্যার আরো দু’টি খবর। মাগুরায় আলাদা জায়গায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার লাবণী আক্তার এবং কনস্টেবল মাহমুদুল হাসানের আত্মহত্যা। পুলিশ আত্মহত্যার এ দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র পেয়েছে। এর আগে-পরেও আত্মহত্যার তালিকাটা দীর্ঘ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। চিকিৎসকদের কারো কারো মতে, আত্মহত্যা একটি রোগ বা রোগের জের।
এক কথায় ‘রোগ’ বলে ফেললে আলোচনার জায়গাটা ছোট হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসা তো অবশ্যই থাকে, থাকা উচিত। সেইসাথে ভাবনার বিষয়, কেন রোগটির বিস্তার বাড়ছে? মোটকথা আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বা করোনাকে কারণ হিসেবে চালিয়ে দিলেও যুক্তির অভাব হবে না। তবে, তা হবে ঘটনা পাশ কাটানোর অপচেষ্টা।
নানা বিশ্লেষণ ও কেসস্টাডিতে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, বেকারত্ব, পেশাগত অশান্তি, আর্থিক সঙ্কট ইত্যাদি আত্মহত্যার পেছনের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দেশে গত কয়েক বছর ধরে আত্মহত্যার ঘটনা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর গত কয়েক বছর মানে, করোনাকাল।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যু এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ। আর নানা ঘটনায় উদ্বেগ-আতঙ্ক আরো আগ থেকেই। ক্রমে তা কেবল বাড়ছে। করোনার ধকল কমে আসার পরও উদ্বেগ-অস্থিরতা কমেনি, বরং বেড়েছে। সেইসাথে হতাশা, বিষণ্নতা ভর করেছে বেশ পাকাপোক্তভাবে যার নানামুখী জেরে নানা অসুখ-বিসুখের সাথে ধকল পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞরা একে আত্মহত্যার একটি কারণ বলে শনাক্ত করেছেন। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি।
সর্বশেষ এক গবেষণা বলছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা, ৫ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ ছোট বা মামুলি মনে হলেও ওই ব্যক্তির কাছে সেটি অনেক বড় কারণ। আর করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। যেকোনো নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্র ও পরিবার, উভয়েরই।
কম বোধ-বুদ্ধি বা কম শিক্ষিত লোকেরা আত্মহত্যা বেশি করে বলে একসময় একটা কথার প্রচলন ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কেসস্টাডি তা বলছে না। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা কম নয়, বরং বেশি। সুশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিতরাও আছেন এ তালিকায়। রয়েছেন সমাজের নামিদামি, প্রতিষ্ঠিত-সামর্থ্যবানরাও। এটিও গবেষণার একটি উপাদান হতে পারে।
করোনা এবং করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে শিশু থেকে বয়স্কসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে মানসিক-অর্থনৈতিক অশান্তি বেড়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। এটি স্বীকার-অস্বীকারের বিষয়ও নয়। অনেকে নিজ থেকেও এর চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারি হিসাব বলছে, পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে মহামারী শুরুর আগে যে সংখ্যক রোগী ভর্তি হতো, তার চেয়ে এখন মাসে গড়ে হাজারও বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের সবাই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নয়, নিজ গরজেও আসছেন।
মহামারীতে চাকরি হারানো, আয়-রোজগার কমে যাওয়া, জীবিকা ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্বজনের মৃত্যু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন কারণে অনেকেই মানসিক বিপর্যয়ের শিকার। আরেক হিসাব বলছে, গত দুই-আড়াই বছরে করোনায় যে সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মারা পড়েছে আত্মহত্যায়। আত্মহত্যা নিয়ে দেশে প্রকাশিত গবেষণাগুলোর তথ্য হচ্ছে, এ সবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল কারণ পারিবারিক চাপ-অশান্তি- হতাশা-ক্ষোভ-লজ্জা।
মহামারীর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগাতার বন্ধের সময় ২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ছাত্র ৬৫ জন। আর ছাত্রী ৩৬ । তাদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২-২৫ বছর বয়সীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা অনুযায়ী, সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর পারিবারিক সমস্যায় ১৯.৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ। পড়াশোনাসংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ শতাংশ এবং আর্থিক সমস্যাকবলিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বিষন্নতা-ক্ষোভ-জেদ-লজ্জা যে কারণেই হোক, শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার এ প্রবণতা বড় রকমের অশনিসঙ্কেত। পুলিশের মতো একটি সুশৃঙ্খল-প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা আরো বেশি অশনিসঙ্কেত। সরকারি গড় হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে আত্মহত্যায় মৃত্যু ১১ হাজার। গত বছর মহামারীতেই ১৪ হাজার মানুষের আত্মহত্যার বাইরে সাম্প্রতিককালে লাইভে এসে বেশ কয়েকজন শিক্ষিত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ভাইরাল হওয়া মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাবনাকেও প্রভাবিত করে দিয়েছে। বিষণ্নতা আত্মহত্যার প্রাথমিক ধাপ। শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশায় বিষণ্নতার বিস্তার রুখতে একতরফা বা একপক্ষীয় কোনো সমাধান নেই। দীর্ঘমেয়াদে তা কোথায় গড়াবে, ধারণারও বাইরে। যদ্দুর সম্ভব, সমাধান খুঁজতে হবে শর্টকাটে, মোটেই দীর্ঘমেয়াদে নয়।
অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুলপড়ুয়া শিশুও এ তালিকাভুক্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে নানা কথা হচ্ছে পথে-ঘাটে-মাঠে। ধর্মাশ্রয়ীরা একে নিয়ে যাচ্ছেন আজাব-গজবসহ নানা দিকে। ওইসব কথায় সমর্থন দেয়া অনেক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার অগ্রাহ্য করে পাল্টা যুক্তি দাঁড় করানোও ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের সামজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে চলছে দ্রুত যা পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে বন্ধন। সবাইকে করে ফেলছে অতি মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক। তা মানসিক চাপ সহ্যের সক্ষমতাকে তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। এর অনিবার্য কুফল থেকে বাঁচার রাস্তা খোঁজা জরুরি। অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, আবেগীয় বিষয় এবং স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সমস্যাগুলো রুখে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে পারিবারিক-সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের বিষয়-আশয় রয়েছে। বাংলাদেশে ঝিনাইদহকে আত্মহত্যাপ্রবণ প্রধান জেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেলাটিতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০০-এর মতো মানুষ আত্মহত্যা করে। সেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ কিছুটা হলেও কাজে দিয়েছে। এ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও সংগঠনগুলোর অভিজ্ঞতা নেয়া যেতে পারে গোটা দেশের জন্য।
তাছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সাথে গুণগত সময় কাটাতে হবে। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে একসাথে মানসিকভাবে পাশে থাকতে হবে। শিশুদের মানসিক বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন- ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি রোধে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সাথে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী এসব চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত
জনস্বার্থে-
হাই-টেক মডার্ণ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল
মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগের অনন্য চিকিৎসা কেন্দ্র
যেকোন তথ্যে ও সিরিয়ালের জন্য যোগাযোগ করুন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ও সেবা পেতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
হাই-টেক মডার্ণ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল
প্রধান শাখা:
১১৬, মনিপুরীপাড়া (১ নং গেইট), তেজগাঁও, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫.০১৬০২-২৬৮৪০৫,
০১৬০২-২৬৮৪০৬
কেরাণীগঞ্জ শাখা:
সারা প্যালেস (পুরাতন সিনেমা হলের পাশে), আটি বাজার, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।০১৭১১-৬৬২৭০৯,
০১৭৩০-৩৩৩৭৮৯অনলাইনে সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে এখানে ক্লিক করুন