আত্মহত্যার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে সাঈদা ইসলাম তার বন্ধুদের বলেছিলেন, কিছু ভালো লাগছে না তার। টানা বিষণ্ণতার মধ্য দিয়ে যাওয়া সাঈদা একদিন সিলিং ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ সমাজে হাসিমুখের পেছনে কতটা বিষণ্ণতা ও হতাশা লুকিয়ে আছে সেটা দেখার সময় হয়ে ওঠে না কারোরই। হতাশায় সারারাত না ঘুমিয়ে সকালবেলা মুখ ধুয়ে অফিসে আসা, সারাদিন মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে কাজ করা সেই মানুষটা হয়তো কোনো এক রাতে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্তটি নিয়ে বসেন।
ক’বছর আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ইখতেদার সাফওয়ান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি লেখেন, বেঁচে থাকার কোনো গভীর অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। এর আগেও ইখতেদার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার আশপাশের বন্ধুরা ইখতেদার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওকে দেখে আমরা বুঝতে পারিনি, ওর ভেতরে এতো বিষণ্ণতা লুকিয়ে ছিল।’
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের এ সমাজে স্বাস্থ্য খারাপ বলতে সিংহভাগ সময়ই শারীরিক স্বাস্থ্যের কথা বোঝানো হয়। এখানে শরীর খারাপ হলে মানুষ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়, কিন্তু মন খারাপকে দেখা হয় গড়পড়তা এক মানসিক অবস্থা হিসেবে। মন খারাপ পুষে পুষে বিষণ্ণতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে এ মানুষগুলো একদিন আত্মহত্যাকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বেছে নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাকরিজীবী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। আমি যখন মন খারাপের কথা বলতাম, বন্ধুরা বলতো, এ আর নতুন কী? তোমার তো সবসময়ই মন খারাপ থাকে। হেসে উড়িয়ে দিত তারা। মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে আমিও হাসতাম। নিজেকে দেখে খুব অবাক লাগতো। আমি সেই মানুষ যে সকালে বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, আর গতরাতে মরে যাওয়ার জন্য ফ্যানের সঙ্গে দড়ি পর্যন্ত বেঁধেছিলাম।’
বৈশ্বিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে মোটেও হেলাফেলার সঙ্গে দেখা হয় না। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে জোর দিয়ে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর পালিত হয় ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। এবছরও ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ভালো থাকাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার’- এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে পালিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে দিবসের গুণগত মান সভা-সেমিনার পর্যন্তই যে আবদ্ধ থাকে তা পরিসংখ্যান ও নেয়া পদক্ষেপ দেখলেই বোঝা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ৩ কোটি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এতো গেল খাতা-কলমের হিসাব। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সংখ্যা এর চেয়েও তিন-চারগুণ বেশি। বিশেষ করে করোনাপরবর্তী সময়ে দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের বেহাল দশা হয়েছে বলে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যারা আত্মহত্যা করেন কিংবা এ ধরনের প্রবণতায় ভোগেন তাদের একটি বড় অংশ দুশ্চিন্তা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস ডিজঅর্ডার, সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ, হেলথ অ্যাংজাইটি, আর্থিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতার মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেন।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে বয়স্ক ও তরুণদের মধ্যে মানসিক বিষণ্ণতা ও সমস্যার হার সবচেয়ে বেশি। বয়স্কদের মানসিক সমস্যায় আক্রান্তের হার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও তরুণদের ১৩ শতাংশ। ষোল কোটি মানুষের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে ডাক্তার আছেন মাত্র ১ হাজার, যা অপ্রতুল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত আট মাসে ১৯৪ বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৭৬ জন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৪ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৫০ জন। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছেন। এদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রদের তুলনায় বেশি।
২০২১ সালের আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, করোনাকালে গত বছর মোট ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ফাউন্ডেশনটির গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যা করা এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছিলেন ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যায় ছিলেন ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা নিয়ে চাপের মধ্যে ছিলেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এছাড়াও আর্থিক সংকট, মাদকাসক্ত ও অন্যান্য কারণে ২৮ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনতে প্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিংয়ের দিকে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়রাম্যান অধ্যাপক সাদেকা হালিম সময় সংবাদকে বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জোর দিতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিং ব্যবস্থা। দেশের আরেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা সময় সংবাদকে জানান, কাউন্সেলিংয়ের জন্য একটি রুম দেখেছি, সেখানে একজন বসেন। কিন্তু কীভাবে কী হয় আমরা বিস্তারিত জানি না। মিরপুরের আরেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের বিভাগভিত্তিক কাউন্সেলিং ব্যবস্থা আছে, যেখানে শিক্ষকরাই কাউন্সেলিং করে থাকেন। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তাদের কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা খুলে বলতে স্বস্তিবোধ করেন না।
দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানকার কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চলছে নামকাওয়াস্তে। হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী সেখানে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য আলাদাভাবে সেশনপ্রতি ১০০ টাকা দিতে হয়। যে শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য হতাশ, হাতে টাকা নেই, তাকে কাউন্সেলিং পেতে গেলে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আর তারা যেসব সমাধান দেয় সেগুলোও খুব একটা কাজে লাগে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সময় সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশে কাউন্সেলিং ব্যাপারটা এখনো তেমন পরিচিতি পায়নি। আপনি সাইক্রাটিস্টের কাছে গেলে আপনাকে একগাদা এন্টি-ডিপ্রেশন পিলের নামে ঘুমের ওষুধ ধরিয়ে দেবে। অনেকেই অভিযোগ করেন এন্টি ডিপ্রেশন পিল হতাশা না কমিয়ে উল্টো বাড়ায়। কেননা ঘুমিয়ে থাকা তো কোনো সমাধান হতে পারে না।
মন খারাপ, হতাশা ও বিষণ্ণতায় ভোগা একজন মানুষ জীবনের এক পর্যায়ে এসে বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে ফেলে। সেখানে হতাশা নামক গভীর খাদ থেকে তাকে তুলে আনতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে জোর দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, দেশের স্বাস্থ্যখাতে মানসিক স্বাস্থ্য নিজেই এখন খাদের কিনারায়। এখনই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে জোর না দিলে, সামনে বড় রকমের সমস্যা সৃষ্টি হবে- এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র: সময় সংবাদ
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ও সেবা পেতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
হাই-টেক মডার্ণ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল
প্রধান শাখা: ১১৬, মনিপুরীপাড়া (১ নং গেইট), তেজগাঁও, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫.
কেরাণীগঞ্জ শাখা: সারা প্যালেস (পুরাতন সিনেমা হলের পাশে), আটি বাজার, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।০১৭১১-৬৬২৭০৯,
০১৬০২-২৬৮৪০৫,
০১৬০২-২৬৮৪০৬অনলাইনে সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে এখানে ক্লিক করুন