সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বেশ অস্থির একটা সময় কাটিয়েছে সবাই। শিক্ষার্থীরা যেহেতু এই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এবং তাদের সম্পৃক্ততা-ক্ষয়ক্ষতি বেশি ছিল, এর প্রভাব এখনও রয়ে গেছে তাদের মনে। অনেকেই মানসিক ট্রমায় পড়েছেন, স্বাভাবিক জীবনটাকে যেন অচেনা লাগছে। এই অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
মানসিক ট্রমায় যারাঃ
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার, যারা সামনে থেকে হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা উদ্ধার করেছেন, চিকিৎসা করেছেন, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং যারা বাড়িতে বসে টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নৃশংসতার ভিডিও দেখেছেন, বর্ণনাগুলো পড়েছেন তাদের প্রত্যেকের মনের ওপর এক ধরনের চাপ পড়েছে।
শুধু প্রত্যক্ষভাবে যারা যুক্ত ছিলেন তারাই নন, পরোক্ষভাবে যারা ঘরে ছিলেন তাদের মধ্যেও এক ধরনের মানসিক ট্রমা, মানসিক চাপ পড়েছে। যেমন-অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা তীব্র মানসিক চাপ, তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র মানসিক চাপে ভুগতে পারেন অনেকে। এর ফলে তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা হবে, ঘুমের সমস্যা হবে, নানা ধরনের আচরণজনিত সমস্যা হতে পারে।
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারঃ
দীর্ঘমেয়াদীভাবে আরও কিছু দিন পর এই ট্রমার বিভৎসতা, নির্মমতা, নৃশংসতা এগুলো যখন তাদের স্মৃতিতে চলে আসবে তখন তাদের ভেতর পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। যারা একদম শিশু, যাদের বয়স ৫ কিংবা ৭ বছরের কম তারা যখন এই বিভৎসতা, নৃশংসতাগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সহপাঠীদের কাছ থেকে শুনেছে, তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা হতে পারে ভবিষ্যতে। তাদের মধ্যে ট্রমা, আতঙ্ক, ভয়, বিষণ্নতা এই ধরনের সমস্যা হতে পারে।
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন. উদ্ভুত ঘটনার ফলে যাদের ওপর মানসিক চাপ পড়েছে, যারা উদ্বিগ্ন হয়েছেন, মন খারাপ করেছেন এটা তাদের দুর্বলতা না বরং তাদের মানবিক গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। তাদের একটি মানবিক মন আছে বলেই দুঃখ পেয়েছেন, মানসিক চাপ, হতাশা তৈরি হয়েছে। এগুলো হতেই থাকবে। কিন্তু এর প্রতিকারও মাথায় রাখতে হবে।
প্রতিকারঃ
এই স্ট্রেস লেভেল বা মানসিক চাপ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আন্দোলনে পতিত হয়েছেন, বিভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছেন, আপনজন হারিয়েছেন তারপরেও সবাইকে ভবিষ্যতের জন্য, নিজের ও অপরের জন্য, সমাজের জন্য একটি ভালো রাষ্ট্র, ভালো সমাজ ও পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করতে হবে।
মানুষ যত বেশি গঠনমূলকভাবে সৃজনশীলতার ও বিনির্মাণের দিকে অগ্রসর হবে তত তার ট্রমার স্মৃতিগুলো কমতে থাকবে। তখন সে একটি সৃষ্টিশীল স্মৃতির দিকে, ভালো কিছুর দিকে ধাবিত হবে।
ট্রমা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সবাইকে নতুন সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে মনোযোগী হওয়া, আচরণ পরিবর্তনে, চিন্তা বা ধারণার জগৎকে পরিবর্তনে মনোযোগী হওয়া। এগুলো যখন আমরা করতে পারব তখন অনেকাংশে ট্রমা থেকে কাটিয়ে উঠতে পারব।
এ ছাড়া যাদের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা, ঘুমের সমস্যা অথবা ভবিষ্যতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি হতে পারে তাদের অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং, ওষুধ অথবা পেশাদার স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে।
স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে-শিক্ষাজীবনে ফিরে যেতে করণীয়ঃ
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ছাত্র আন্দোলনের ঘটনার পর খুব বেশি দিন অতিবাহিত হয়নি। তাই একটু সময় দিতে হবে স্থিতিশীলতা আনার জন্য। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে ফেরানোর জন্য অন্তবর্তী সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে শিক্ষর্থীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে শিক্ষাঙ্গণ এখন তাদের জন্য নিরাপদ।
কর্মজীবীদের কাজে ফেরানোর জন্য যারা কর্তৃপক্ষ আছেন তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে কর্মক্ষেত্র তার জন্য নিরাপদ। অর্থাৎ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পুনরায় প্রবেশ করতে হবে, পুনর্মিলনের জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এখানে পুনঃস্থাপনের বিষয়টি জোরদার করতে হবে।
এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে করণীয়-
এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে করণীয়-
১. প্রথমত মনের যত্ন নেওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো করা দরকার সেগুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
২. প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে হবে এবং দিনে সক্রিয় থাকতে হবে। ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে রাতে ঘুমাতে হবে।
৩. পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেতে হবে এবং পরিমিত পানি পান করতে হবে।
৪. কোনোভাবেই রাত জাগা যাবে না, রাত জেগে টেলিভিশন দেখা, মুভি দেখা যাবে না।
৫. ইন্টারনেট ব্যবহার ও স্ক্রিনিংয়ের সময় কমাতে হবে। কারণ সেখানে আমরা নানা রকম বিষয় দেখি যা আমাদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে, আরও বেশি মানসিক চাপে ফেলে দেয়।
৬. পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গুণগত সময় দিতে হবে, তাদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হবে।
৭. যারা আহত হয়েছিলেন, বিপর্যস্ত হয়েছিলেন, অনেকে ঘড়বাড়ি হারিয়েছেন- নিজের জায়গা থেকে তাদেরকে উপকার বা সহায়তা করা যেতে পারে। এতে করে আত্মমর্যাদা বাড়বে, নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে, মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি এই বোধ তৈরি হবে।
৮. প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় বই পড়া, গান শোনা, ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখবে।
৯. প্রতিদিন নিজেকে একবার করে ধন্যবাদ দিতে হবে। নিজেকে ধন্যবাদ দেওয়া, নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সেটিও কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে। আর যদি মানসিক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
১০. সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ও সর্তকতা। সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যখন নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশি দেখব, ঘৃণাবাচক শব্দগুলো বেশি দেখব, অন্যকে উসকানি দেওয়া, উত্তেজিত করার মতো বিষয়গুলো দেখব সেগুলো মানুষের মনোজগতকেও পরিবর্তন করবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সেল্ফ ফিল্টারিং থাকতে হবে নিজেদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতক্ষণ থাকব, কী দেখব আর কী দেখব না এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কিছু নীতি বা বিধি রয়েছে, সেটি মেনে চলতে হবে।
এ ছাড়া নানা ধরনের রিউমার স্ক্যানার, ফ্যাক্ট চেকার আছে এগুলোর সাহায্য নিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া যেন আমাদের মূল বিনোদন বা সময় কাটানোর মূল উপজীব্য হয়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া আমরা ব্যবহার করব। কিন্তু এটি যেন আমাদের জীবনকে পরিচালিত না করে।
আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কমিয়ে সামাজিকভাবে অভ্যস্ত হতে হবে। মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হবে, আড্ডা দিতে হবে, গল্প করতে হবে, বেড়াতে যেতে হবে এই জিনিসগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভিন্ন মত বা যেকোনো কারণেই হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আগে ও পরে অনেকের সঙ্গে সর্ম্পকে ঘাটতি তৈরি হয়েছে সবার।
সেটি দূর করা প্রসঙ্গে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সমাজ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ না, বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ। যদি আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে না পারি তাহলে এই ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। আমরা মানুষের বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে বিচার করি, তার কাজ কিংবা জ্ঞান দিয়ে নয়। আমরা যখন মানুষকে তার কাজ ও জ্ঞান দিয়ে বিচার করব তখন তার বিশ্বাসের জায়গা গৌণ হয়ে উঠে, তখনই আমরা বলব অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র তৈরি হতে পারে, বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি হতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী শব্দকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, আমরা যদি বৈষম্য দূর করতে না পারি, মানুষে মানুষে বিশ্বাসের কারণে বৈষম্য করি তাহলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। মানুষের বিশ্বাসকে তার ব্যক্তিগত জায়গায় রেখে তার জ্ঞান, কাজ, অর্জন, সমাজে তার অবদান এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলে হিংসা, ঘৃণা ও সম্পর্কহীনতার জায়গাটি থাকবে না। আর এখনই উপযুক্ত সময় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার।
জনস্বার্থে-
হাই-টেক মডার্ণ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল
মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগের অনন্য চিকিৎসা কেন্দ্র
যেকোন তথ্যে ও সিরিয়ালের জন্য যোগাযোগ করুন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ও সেবা পেতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
হাই-টেক মডার্ণ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল
শাখা-১:
সারা প্যালেস (পুরাতন সিনেমা হলের পাশে), আটি বাজার, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।০১৭১১-৬৬২৭০৯,
০১৭৩০-৩৩৩৭৮৯
শাখা-২:
১১৬, মনিপুরীপাড়া (১ নং গেইট), তেজগাঁও, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫.০১৬০২-২৬৮৪০৫,
০১৬০২-২৬৮৪০৬
অনলাইনে সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে এখানে ক্লিক করুন